সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩১ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক:: হাসিনা সরকারের পতনের পরেও বরিশালের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল আবেদীনের ত্রাসের রাজত্ব চলছেই। স্বজনদের নিয়ে গড়ে তোলা বাহিনী বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের পুরো ১০নং ওয়ার্ড দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, বেড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরোটা সময় ধরে কেডিসিসহ আশপাশ এলাকাসমূহের ব্যবসায়ীদের জিম্মি চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন।
শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা, অভিযোগ থাকালেও আইনের আওতায় এসেছেন, এমন উদাহরণ কম আছে। বিস্মময়কর বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের এই নেতাকে বিএপির একটি মামলায় অভিযুক্ত করা হলেও তার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ রোহিত করা যাচ্ছে না। বরং অভিযোগ আছে, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের আমলে এই চাঁদাবাজির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলেছেন। তবে এবার তিনি ‘বরিশাল বিভাগীয় ট্র্যাংক লরি সংগঠনে’ চাঁদাবাজি করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়লেন। ভুক্তভোগীসহ স্থানীয় সুশীল সমাজ, নির্যাতনকারী আওয়ামী লীগ নেতা জয়নালের শাস্তি চেয়ে করেছেন বিক্ষোভ, কর্মবিরতি।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সদস্যকে চাঁদার দাবিতে মারধরের ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গভীর রাতে থানায় এহাজার এবং বুধবার ১৮ প্রতিবাদস্বরুপ শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে শহরের বান্দরোডে উত্তপ্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর একটি টিম ঘটনাস্থলে ছুটে যায় এবং চাঁদাবাজির ঘটনায় জয়নালসহ জড়িত সকলকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার অভয় দিয়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের শান্ত করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের শেষের দিকে কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে জয়নাল কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েই বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ওই নির্বাচনে কোটি টাকা খরচ হয়েছে এবং তা এখন তুলতে হবে- এমন হুঁশিয়ারি দিয়েও ওয়ার্ডের একাধিক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করেন, অভিযোগ আছে। রাজনৈতিক পদধারী এই মূর্তিমান সন্ত্রাস কেডিসির অভ্যন্তরে থাকা প্রিমিয়ার সিমেন্টের গোডাউনের ম্যানেজারকে ফোন করেও চাঁদা দাবি করেছিলেন। এবং হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, কেডিসি এবং চাঁদমারী সড়ক তার ওয়ার্ডে, এই সড়ক দিয়ে সিমেন্ট পরিবহন করতে হলে দিতে হবে মাসোহারা।
তখন জয়নাল এবং তার ছেলে সন্তানসহ গুন্ডাবাহিনীর সাথে কোনো রুপ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে না গিয়ে কোম্পানিটি তাদের গোডাউন শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত কালিজিরায় স্থানান্তর করে। এর আগে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্রাহ’র অনুসারীর স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা সোহেল খানকে তার কর্মস্থল আমান গুদাম থেকে বের করে দিয়ে সেখানে জয়নালের মাদকাসক্ত ছেলে অলি নিয়ন্ত্রণ নেয়।
এবং সারসহ হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার পরিবহনকারী ট্রাক থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলছে। জানা গেছে, কেডিসি ঘাট থেকে ট্রলারে পণ্য তুললেও কাউন্সিলর জয়নালকে দিতে হয় চাঁদা, যা উত্তোলনের দায়িত্ব আছে ওই অলিসহ কজন সন্ত্রাসী। এছাড়া কেডিসি কলোনীতে মাদক বাণিজ্যে শেল্টার দেওয়াসহ নীরিহ বহু মানুষকে অহেতুক মারধর করাসহ হয়রানি করেছে জয়নাল বাহিনী।
এই আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে আশরাফুল বেলসপার্ক মাঠে জনাকীর্ণ স্থানে গাঁজা সেবন করতে গিয়ে রক্তারক্তি পরিস্থিতি তৈরি করে। মাদক সেবনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জয়নাল বাহিনীর হামলার শিকার হন খোদ ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট তৌহিদ মোর্শেদ টুটুলের স্ত্রী সিফাত জাহান মিম। সেই ভয়ানক ত্রাসের ঘটনায় কাউন্সিলর পুত্র আশরাফুল হকসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়েছিল (জিআর ৭১০/২৩)।
এছাড়া পাশাপাশি সময়ে শহরের মুসলিম গোরস্থান এলাকায়ও একটি সন্ত্রাস তৈরি করেছিল জয়নাল বাহিনী, সেই ঘটনায়ও আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে এনা এবং অলিসহ অন্তত ২০ জনের বিরুদ্ধে কোতয়ালি থানায় একটি মামলা হয় (জিআর নং-৫৪৬/২৩)। এছাড়া সাদিকপন্থী শ্রমিকলীগ নেতা সোহেল খানও অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে কাউন্সিলর জয়নালের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে অভিযোগটি তুলে নিতে বাধ্য করেন আ’লীগ নেতা জয়নাল।
সূত্রগুলো জানায়, এতসব অপকর্ম করার পরেই জয়নালের লোলুপ দৃষ্টি যায় ‘বরিশাল বিভাগীয় ট্র্যাংক লরি সংগঠনে’। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষান্তে এই সংগঠনে পদ বাগিয়ে নেওয়াসহ ক্যাডার বাহিনী নিয়ে দখলের পায়তারা করতে থাকেন। তখন একটি গ্রুপ বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন বরিশাল সদর আসনের এমপি জাহিদ ফারুক এবং সিটি মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহসহ পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এরপর কিছুদিন জয়নাল চুপচাপ থাকলেও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে তিনি বোল পাল্টে নিজেকে সাবেক বিএনপি নেতা দাবি করছেন এবং অর্থবিত্তে লালে লাল হয়ে যেতে দখল সন্ত্রাসে মেতে উঠেছেন। কিন্তু বাধ সাধল শ্রমিক সংগঠনে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে, আর এতেই ধরাশয়ী হতে যাচ্ছেন কাউন্সিলর জয়নাল। তার শাস্তি দাবি করেছেন শ্রমিক সংগঠনটিসহ স্থানীয় সুশীল সমাজ।
শ্রমিক সংগঠনের অভিযোগটিতে আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল, তার ভাইয়ের ছেলে রাজু, জামাতা শামীম, রিপন, আনোয়ার, সাঈদ, ইমরান, মুজাম্মেল, নুর আরাফাত আকন, ওসমান ফকিরসহ ২০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
আলোচিত সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শেখ কামাল হোসেন অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল গত বছরের শেষের দিকে কাউন্সিলর হয়েই ক্যাডার বাহিনী নিয়ে ‘বরিশাল বিভাগীয় ট্র্যাংক লরি সংগঠন’ দখলের পায়তারা শুরু করেন। কিন্তু তাতে তিনি ব্যর্থ হয়ে পরিশেষে সংগঠনে ঢোকার চেষ্টা করাসহ গাড়িপ্রতি চাঁদা দাবি করেছিলেন। তৎকালীন বিষয়টি বরিশাল সদর আসনের এমপি এবং মেয়রকে অভিযোগ আকারে অবহিত করা হলে জয়নাল কিছুদিন নিশ্চুপ থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে নিজেকে সাবেক বিএনপি নেতা পরিচয় দিয়ে উৎপাত শুরু করেন।
এর প্রতিবাদ করায় মঙ্গলবার সংগঠনের অর্থ সম্পাদক রানা সরদার আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল বাহিনীর ত্রাসের শিকার হয়েছেন, যে ঘটনায় সেদিন গভীর রাতেই থানায় অভিযোগ করাসহ বিষয়টি সেনাবাহিনীকে অবহিত করা হয়। এবং সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদসহ হামলাকারীদের শাস্তি দাবি জানিয়ে বুধবার সকাল থেকে কর্মবিরতি পালন করা শুরু করে শ্রমিকেরা। এতে বরিশাল থেকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে দুর্ভোগের আশঙ্কা তৈরি হয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী এবং কোতয়ালি পুলিশ গিয়ে পরিবেশ শান্ত করে আওয়ামী লীগ নেতা জয়নালসহ জড়িত সকলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণের মধ্যদিয়ে।
সেনাবাহিনীর ওই পদস্থ কর্মকর্তা আল আমিন সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শ্রমিকদের জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল আছেন। এবং জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করা যাবে না, জানিয়ে সেনা কর্মকর্তা বলেন, এই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থাগ্রহণ করবে।
স্থানীয় সুশীলমহল বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতা জয়নালের অপকর্মের শেষ নেই, তিনি ওয়ার্ডটিতে কাউন্সিলর হিসেবে যে কয়বার দায়িত্ব পালন করেছেন, প্রতিবারই সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছেন। তবে সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র থাকাকালীন জয়নাল তেমন একটা সুবিধা না করতে পারলেও চলতি বছরের শেষ দিকে কাউন্সিলর হয়ে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ’র সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং দেদার সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি শুরু করে দেন। সবশেষ অন্তর্র্বতী সরকারের এই সময়ে শ্রমিক সংগঠনে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে নেতৃবৃন্দকে মারধরের যে দু:সাহস দেখিয়েছেন, তাতে অনেকেই রীতিমত অবাক হয়েছেন। এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থাগ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন।
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, এই সন্ত্রাসের ঘটনায় কোতয়ালি থানায় একটি চাঁদাবাজির মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে কোতয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাতে একটি অভিযোগ এসেছে’ সেটির তদন্ত চলছে। পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।